ফোকলোর চর্চায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান বাংলার লোকসাহিত্য চর্চার পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিপ্রাণ ছিল নিত্যনতুন ভাব, রূপ ও রসের পিপাসায় আকুল। আর তাই উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যখন বাংলার বিভিন্ন পণ্ডিত ফোকলোরের বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন তার পুরোভাগে ছিলেন। তিনি প্রথম বাঙালী যিনি নিজ উদ্যোগে লোকমুখে প্রচলিত ছড়া, প্রবাদ সংগ্রহ করেন। তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্বের লোকসাহিত্যের প্রতি এরূপ আগ্রহ দেখে সে সময়ে অনেকেই ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহে এগিয়ে আসে। ফলে গুণিমহলে এর চর্চা শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে সমাদৃত হতে শুরু করে। স্বীকার করতেই হবে যে রবীন্দ্রনাথই প্রথমে লোকসংস্কৃতি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দিকে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ মে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ( ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ) কলিকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পরিবারটি পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের ছিল। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবী। শিক্ষাজীবনে তিনি বিভিন্ন শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে স্বগৃহে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি লাভ করেন। এরপর কলিকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনার, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমী, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়লেও কোথাও মন বসেনি। শেষ পর্যন্ত আবার বাড়িতেই তাঁর পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হয়।
কবিপ্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আট বছরে কবিতার সূত্রপাত। কবিমাত্রই অনুভূতিপ্রবণ । রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর সে সময়ের অনুভূতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর নিজেরই বক্তব্যে - " বাল্যকাল দিন কেটেছে শহরে খাচার মধ্যে, বাড়ির মধ্যে। শহরবাসীর মধ্যেও ঘুরে ফিরে বেড়াবার যে স্বাধীনতা থাকে, আমার তাও ছিলনা। একটা প্রকান্ড অট্টালিকার কোণের ঘরে ছিলাম বন্ধী।......" রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম আমাদের লোকসাহিত্য সংগ্রহ, আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করেন। তিনি লোকসাহিত্যের অন্তর্নিহিত রসতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করে বাংলা লোকসাহিত্যের ইতিহাসে একটি অমর অধ্যায় যুক্ত করেছেন। লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি আজও একটি একক আসনের অধিকারী, তিনিই এ ধারার সূত্রপাত করে আমাদের পথিকৃৎ হয়ে আসেন। ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যকার গোপন গভীর বিশ্বটির সন্ধান দিয়ে তিনি আমাদের জন্য শুধু নয়, আগামীকালের জন্যও একটি জ্যোর্তিময় দলিল রেখে গিয়েছেন। # রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র ২২ বছর বয়সে বাংলার লোকসাহিত্যের উপাদানগুলো সংগ্রহ করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য বলে সচেতন করেন এবং সংগ্রহ কাজে নিজে নিয়োজিত হন। এ সম্পর্কে তাঁর অভিমত - " বাঙ্গালা ভাব ও ভাবের ভাষা যতই সংগ্রহ করা যাইবে , ততই যে আমাদের সাহিত্যের উপকার হইবে তাতে সন্দেহ নাই।" আর তাই ছড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কারণ ব্যক্ত করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - " ইহা আমাদের জাতীয় সম্পত্তি। বহুকাল হইতে আমাদের দেশের মাতৃভান্ডারে এই ছড়াগুলি রক্ষিত হইয়া আসিয়াছে।.......আজকাল এই ছড়াগুলি ক্রমশই বিস্তৃত হইয়া যাইতেছে। অতএব জাতীয় পুরাতন সম্পত্তি সযত্নে সংগ্রহ করিয়া রাখিবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে।" ( বরুণ কুমার চক্রবর্তী,বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার ইতিহাস)
রবীন্দ্রনাথ যে শুধু গ্রাম বাংলার লোকমুখে প্রচলিত ফোকলোরের বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করেছেন তা নয় এগুলোকে সংকলিত করে বিশ্ব দরবারে সকলের নিকট পরিচিত করেছেন। তাই ফোকলোর চর্চায় তাঁর অবদানকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত : ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহ। দ্বিতীয়ত : ফোকলোরের উপাদান সংকলন এবং পুস্তক আকারে প্রকাশ। তৃতীয়ত : পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ' গ্রামসাহিত্য ' প্রবন্ধে লোকসাহিত্য সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। পাবনা থেকে রাজশাহীতে নৌকাযোগে ভ্রমণ করার সময় তিনি মাঝির কণ্ঠে যে গান শুনেছিলেন তাতে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি শুনেছিলেন - "যুবতী ক্যান বা কর মন ভারী, পাবনা থ্যাহে আন্যা দেব ট্যহা - দামের মোটরি।। " গানের এই দুটি চরণ থেকে তিনি শৈবালবিকীর্ণ জলমরুর মাঝখান থেকে সমস্ত গ্রামগুলির কথা শুনতে পেয়েছিলেন। লোকসাহিত্য বা দেশীয় সাহিত্যের শিকড় যে গাছের শিকড়ের ন্যায় মাটির সঙ্গে জড়িত তিনি সে প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন - " গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে। " ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকসাহিত্য, কলিকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় ) # রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাণের টানে ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন, তত্ত্বগত আলোচনার জন্য এর উপাদানগুলো সংগ্রহ করেননি। তাই ছেলেভুলানো ছড়াগুলো সংগ্রহ করেছিলেন মূলত সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন - " বাংলা ভাষায় ছেলে ভুলাইবার জন্য যে সকল মেয়েলি ছড়া প্রচলিত আছে, কিছুকাল হইতে আমি তাহা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত ছিলাম। আমাদের ভাষা এবং সমাজের ইতিহাস নির্ণয়ের পক্ষে ছড়াগুলির বিশেষ মূল্য থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে যে একটি সহজ স্বাভাবিক কাব্যরস আছে, সেটিই আমার নিকট আদরণীয়বোধ হইয়াছিল।"
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন শাখায় লোকউপাদান ব্যবহার করেছেন। লোককথা, লোকবিশ্বাস, লোকাচার, লোকপুরান, লোকছড়া, বাউলগান প্রভৃতি তাঁর কাব্য, সঙ্গীত, নাটক, উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। তিনি লোককথাকে মানবজীবনের অপরিহার্য অঙ্গরূপে বিবেচনা করেছেন। বিভিন্ন কাব্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ' কড়ি ও কোমল ' কাব্যের ' বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর ' কবিতাটিতে প্রথম স্তবকে কবি বলেছেন - ' বাদলা হাওয়ায় মনে ছেলে বেলার গান।' এখানে তিনি রূপকথার প্রসঙ্গই টেনে এনেছেন - " মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা, মনে পড়ে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা।" প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের প্রবল স্বজাত্যবোধ তাকে লোকসংস্কৃতির উৎস সন্ধান ও তার মূল্যায়নে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
লোকসাহিত্য সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভক্তদের উৎসাহিত করতেন। তিনি এক চিঠিতে দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে লিখেছিলেন - " আমরা বাংলার প্রত্যেক জেলা থেকে এই সমস্ত গণশিল্প সংগ্রহ করতে ব্রতী।" লোকসাহিত্য চর্চার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি কেবল নিজেই লোকসাহিত্য - সংস্কৃতি সংগ্রহ ও মূল্যায়নে ব্রতী হন নি ; তাঁর প্রেরণায় আরো অনেকেই একাজে উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসেন। ' ছেলে ভুলানো ছড়া ' সংগ্রহে লোকসাহিত্য চর্চার তিনি যে পথ নির্দেশ করেছিলেন, পরবর্তীকালে দীনেশ চন্দ্র সেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ সেই পথ নির্মাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত একজন গুণী সাহিত্যিকের লোকসাহিত্যের প্রতি এইরূপ অনুরাগ ও মূল্যায়ন তৎকালীন অনেক সাহিত্যিককে এবং অনেক তরুণ গবেষকদের উদ্বুদ্ধ করে ফোকলোরের বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহে। আর তাঁর সবচেয়ে বড় সফলতা এখানে যে, ফোকলোর চর্চায় তাঁর পুস্তক প্রকাশের ফলে তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়নি বরং এটি সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর পরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এদেশে ফোকলোর চর্চা হয়ে আসছে এবং ধীরে ধীরে তা আরও গতিশীল হচ্ছে। এর প্রমাণ বিভিন্ন সাহিত্যিকগণ ফোকলোর চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে এক সময়ের স্বেচ্ছা প্রণোদিত সংগ্রহের ধারা কালক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধির স্তরে উন্নীত হয়। যার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানে ফোকলোর চর্চা। লোকসংস্কৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় এবং সম্পৃক্তি উদ্দেশ্যহীন ছিলনা। সচেতনতা ছিল বলেই তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে লোক উপকরণের ব্যবহার করেছেন। লোকসংস্কৃতির প্রতি যথেষ্ঠ কৌতূহল এবং ভালোবাসা তাঁর বিভিন্ন কর্মের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। অবশেষে বাংলার এই ফোকলোরবিদ ৭ আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ ( ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। বাংলার ফোকলোর চর্চার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর অসাধারণ কর্মের জন্য, আদর্শের জন্য।
তথ্যসূত্র: * বাংলাদেশের ফোকলোর সাধক; মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন; ২০০৭