আশুতোষ ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৯ সালের ১৭ ই জানুয়ারি ময়মনসিংহে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের শিক্ষার হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তাঁর পাঠ সমাপ্ত হয় কিশোরগঞ্জ শহরে। তিনি ১৯২৬ সালে প্রবেশিকা পাশ করেন কিশোরগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে । ১৯২৮ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ. পাশ করেন। ১৯৩১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করেন। ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও সংস্কৃতে এম.এ. পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। আশুতোষ ভট্টাচার্য অধিকতর স্নেহধন্য ছিলেন ড. সুশীল কুমার দে এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এম.এ. পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ড. দে তাকে গবেষণা বৃত্তি দিয়ে তাঁরই তত্ত্বাবধানে রিসার্স স্কলার রূপে নাম রেজিস্ট্রি করান। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল " Later History of Chaitanya Movement"। মধ্যযুগের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি ছিল গবেষণা তথ্যের প্রধান উপাত্ত। এই দূরূহ কর্মে তিনি মনোযোগ ঘটাতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তিনি গবেষণা ছেড়ে চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিশিষ্ট অধ্যাপক, আশুতোষ ভট্টাচার্য এর শিক্ষক এবং প্রখ্যাত সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর গ্রহণ করলেন, আর আশুতোষ ভট্টাচার্য ডাক পেলেন ঐ শূন্য পদে যোগদানের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা কলে তাঁর শ্রেষ্ঠ গবেষণা গ্রন্থ " বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস " প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৭-১৯৪৭ একটানা দশ বছর অধ্যাপনা করার পর বঙ্গ বিভাগের কারণে তাকে সপরিবারে চলে যেতে হয় ভারত রাষ্ট্রে । ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী ছেড়ে কলিকাতা যাদুঘরের Anthropological Survey of India এর Research Associate হিসেবে যোগদান করার পর ঢাকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
১৯৫৪ সালে " বাংলার লোকসাহিত্য " বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই বইটির ভূমিকা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশুতোষ ভট্টাচার্য যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন তিনি এই গবেষণা পত্রটি লিখেছিলেন " বাংলার লোকসাহিত্য" এর ছয়টি খণ্ড রয়েছে -
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় " বাংলার লোকসাহিত্য দ্বিতীয় খণ্ড: ছড়া"
১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় " বাংলার লোকসাহিত্য তৃতীয় খণ্ড: লোকসঙ্গীত "
১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় " বাংলার লোকসাহিত্য চতুর্থ খণ্ড: লোককথা "
১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় " বাংলার লোকসাহিত্য পঞ্চম খণ্ড: ধাঁধা "
১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় " বাংলার লোকসাহিত্য ষষ্ঠ খণ্ড: প্রবাদ "
তাঁর " বাইশ কবির মনসা মঙ্গল " প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। " গোপীচন্দ্রের গান " প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ক্ষেত্রে যে সমস্ত মনীষী প্রথম দিকে উদ্যোগ গ্রহণ করেন আশুতোষ ভট্টাচার্য ছিলেন তাদের অন্যতম। তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে অনেকে তাঁকে Father of Folklore বলে গণ্য করেন। দীনেশচন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর এর উপাদান সংগ্রহ কাজের গৌরবোজ্জ্বল ধারার অপমৃত্যু ঘটে। আশুতোষ ভট্টাচার্য সেই ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন। আশুতোষ ভট্টাচার্য সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র - ছাত্রীদের নিয়ে নিজে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে উপাদান সংগ্রহের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৬০ সালে আশুতোষ ভট্টাচার্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গ ভাষা বিভাগের শিক্ষক হন। একই সালে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসাহিত্য নামে একটি কোর্স চালু করেন। তিনি ক্ষেত্র সমীক্ষার প্রচলন শুরু করেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কিছু শিক্ষার্থী সহযোগে প্রতিষ্ঠা করেন " Research Institute of Folk Culture", প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে লোক উপাদান সংগ্রহ করা। ভেরিয়ার এলুইন এর গবেষণা সহকারী থাকাকালে আশুতোষ ভট্টাচার্য নতুন করে আদিবাসী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। তিনি আশুতোষ ভট্টাচার্য কে বুঝিয়েছেন যে শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, ক্ষেত্র সমীক্ষা বা ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হবে। আশুতোষ ভট্টাচার্য এর ছাত্র - ছাত্রীরা পরবর্তীতে বিখ্যাত বাঙালি ফোকলোরবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন :
বরুণ কুমার চক্রবর্তী, দুলাল চৌধুরী, ওয়াকিল আহমদ, তুষার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
১৯৬৬ সালে " বঙ্গীয় লোক - সঙ্গীত রত্নাকর " নামে প্রকাশিত হয় চার খণ্ডের লোক সঙ্গীত বিষয়ক কোষগ্রন্থ। লোক সঙ্গীত নিয়ে এটি আশুতোষ ভট্টাচার্যের সব থেকে বড় কাজ।
আশুতোষ ভট্টাচার্য " বাংলার লোকনৃত্য " নামে বাংলায় দুটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। বাংলা গ্রন্থটি প্রকাশের আগে " ছৌ " নৃত্যের ওপর লেখা - " TheThe Ramayana in Indian Chhau Dance "( 1971), "Chhu Dance of Purylia" ( 1972)
"Chhu Dance of Purulia in Europe" ( 1972)
Chhu Masked Dance of West Bengal in America" ( 1975) নামে ইংরেজিতে চারটি গ্রন্থও প্রকাশ হয়েছিল। এসব গ্রন্থে তিনি "ছৌ" নাচের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন।তাঁর আরও কিছু কাজ হলো :
১৯৬৮ সালে তাঁর সম্পাদনায় "লোকশ্রুতি" নামে ফোকলোর বিষয়ক একটি পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল। * তাঁর " Folklore of Bengali " প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। * তাঁর " The Sun & the Serpent Core of Bengali " প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। * তাঁর " বাংলার লোকসংস্কৃতি " প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে বিদ্যায়তনিক স্তরে রবীন্দ্রনাথ ও দীনেশচন্দ্র সেন এর ধারা অনুসরণ করে ড.আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকসাহিত্য পঠন - পাঠনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র : বাংলার ফোকলোর সাধক; উদয় শংকর বিশ্বাস; ২০১৪
বাংলাদেশের ফোকলোর সাধক; মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন; ২০০৭