প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি হলো হাকালুকি হাওর।হাকালুকি হাওর হলো এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি এবং বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর।প্রচলিত যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি একসময় বাস করতো কুকি,নাগা উপজাতিরা।তাদের নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করা হয় "হাকালুকি",যার অর্থ "লুকানো সম্পদ"। হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় অবস্থিত।এর ভৌগোলিক অবস্থান ২৪°৩৫´-২৪°৪৪´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০১´-৯২°০৯´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গ কিমি।হাওরটি ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের ৪০% বড়লেখা,৩০% কুলাউড়া,১৫%ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০% গোলাপগঞ্জ এবং ৫% বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত।হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী এবং পানাই নদী।এইজলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়।বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারন করে।এই সময় পানির গভীরতা হয় ২-৬ মিটার।ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উজানে প্রচুর পাহাড় থাকায় হাকালুকি হাওরে প্রায় প্রতি বছরই আকষ্মিক বন্যা হয়।ছোট-বড় ২৪০ টি বিল ও ছোট-বড় ১০ টি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওর বর্ষাকালে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়।এই হাওরে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকের বেশি এবং সঙ্কটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পাওয়া যায়।হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি।এছাড়া ১৪১ প্রজাতির অনান্য বন্যপ্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ, তন্মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিভিন্ন পর্যায়ে বিপন্নপ্রায়।এছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের কীট-পতঙ্গ,জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অনুজীব। হাকালুকি হাওরকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা বিবেচনা করা হয়।পরিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষিত এই হাওরের আশেপাশে প্রায় ১,৯০,০০০ মানুষ বসবাস করেন।এই জলাভূমির সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এবং টেকসই ব্যবহারের জন্য রামসার এলাকা হিসেবে এটি সংরক্ষিত।বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর সেখানে কিছু কিছু জায়গায় ধান চাষ করা হয়। ফসল কাটার পর বিলগুলিতে হাজার হাজার গবাদি পশু বিচরণ করে।এই বিচরণ ভূমির কারণে বহুকাল আগে থেকেই হাওর এলাকায় গড়ে ওঠে বাথান পদ্ধতি। ঐতিহ্যগতভাবে হাকালুকি অঞ্চল দুধ ও দধির জন্য বিখ্যাত।হাকালুকি হাওরে প্রচুর পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে।মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, এই হাওর হলো মাদার ফিশারী।এখানে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির মাছ রয়েছে।হাওরের স্বাদু ও মিঠাপানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে, আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরও নানা প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তির পথের মাছগুলো।হাওর এলাকায় প্রধানত পেশাদার জেলে, মৌসুমি জেলে ও খোরাকি জেলেদের বসবাস রয়েছে।হাকালুকি হাওরে সাধারণত দুধরনের গাছ জন্মে: শেকড়ধারী (rooted) আর ভাসমান।তবে এক সময়ের অন্যতম আকর্ষণীয় Swamp Forest অর্থাৎ জলময় নিম্নভূমির বনাঞ্চল এখন আর তেমন নেই।বর্ষাকালে এই হাওরে ধারণ করে এক অনবদ্য রূপ। চারদিকে শুধু পানি আর পানির খেলা।এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, ইকোটুরিজ্যম শিল্প বিকাশের এক অসাধারণ আধার।প্রতিবছর হাকালুকিতে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে প্রকৃতি-পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হাকালুকির প্রকৃতির ঐশ্বরিক সৌন্দর্য উপভোগ করাই উত্তম। [তথ্যসূত্র:গুগল]