স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুই পাশে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম সুপার এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সুপার এক্সপ্রেসওয়ে বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক।সড়কটির নান্দনিকতার চমৎকার এক নিদর্শন ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় বা ভাঙ্গা গোল চত্বর। কুমার নদের তীরে অবস্থিত ফরিদপুরের একটি উপজেলা ভাঙ্গা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গার মোড়ে এসেই আপাতত থেমেছে এই এক্সপ্রেসওয়েটি। ভাঙ্গা উপজেলা শহর এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা গোল চত্বর পর্যন্ত এই এক্সপ্রেসওয়েটি চালু হলেও এর পুরো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর। ঢাকার জুরাইন থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের এই প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে এশিয়ান হাইওয়ের করিডর ১-এর অংশ হয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ঢাকা ও কলকাতাকে যুক্ত করবে। সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের মে মাসে। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা- মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটি ২০২২ সালের ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন।ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে ভাঙ্গার মোড়টি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২০২২ সালের এপ্রিলে।২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই বিপুল কর্মযজ্ঞে অর্থ জোগানদাতা বাংলাদেশ সড়ক বিভাগ।২০১৬ সালে একনেকে অনুমোদন পায় এটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যৌথভাবে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর এবং ফরিদপুর জেলার এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্ধারিত সময়সীমার তিন মাস আগেই নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।।আগামী ২০ বছর পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখেই দৃষ্টিনন্দন এই মহাসড়কটি তৈরি করা হয়েছে। দ্রুতগতির এই এক্সপ্রেসওয়েটিতে রয়েছে দুটি সার্ভিস লেন, ৫টি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস, ২টি ইন্টারচেন্জ, ৪টি রেলওয়ে ওভারব্রিজ, ৪টি বড় সেতু, ২৫টি ছোট সেতু ও ৫৪টি কালভার্ট। এই এক্সপ্রেসওয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভালের দ্বায়িত্ব পালন করে মুন্সিগঞ্জ সড়ক বিভাগ। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সময় নতুন রূপে গড়ে তোলা হয়েছে ভাঙ্গার এ গোলচত্বরকে।
মোংলা সমুদ্র বন্দর, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, পায়রা সমুদ্র বন্দর আর দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগের প্রবেশদ্বার ভাঙ্গার মোড়ের গোলচত্বর। ভাঙ্গার গোল চত্বর থেকে চার লেইনের সুপরিসর চারটি সড়ক চলে গেছে চার দিকে। উত্তর দিকের সড়কটি ফরিদপুর জেলা সদর হয়ে রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরের দিকে গেছে। এ সড়ক ধরেই দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পার হয়ে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাওয়া যায়। ভাঙ্গা মোড় থেকে পশ্চিম দিকের সড়কটি গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর হয়ে বেনাপোলের দিকে চলে গেছে। ভাঙ্গার মোড় থেকে দক্ষিণের সড়কটি চলে গেছে মাদারীপুর হয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটার দিকে।পূর্বে মাদারীপুর হয়ে পদ্মা সেতু পার হলেই ২০-২২ মিনিটে ঢাকা। ভাঙ্গা গোল চত্বর থেকে পূর্ব দিকে যে সড়কটি চলে গেছে, সেটি হলো দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মা সেতু হয়ে এ সড়কের গন্তব্য ঢাকা।ভাঙ্গার গোল চত্বর হয়ে সহজে যাওয়া যায় ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর প্রভৃতি জেলা সদরে।এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে থাকা দুটি করে সার্ভিস লেন দিয়ে চলবে স্থানীয় যানবাহন। ভাঙ্গা সড়ক মোড়ের চারপাশ এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে, বরিশাল, খুলনা, ঢাকা বিভাগের যে কোনো জেলায় যাতায়াত করা যাবে কোনো ক্রসিং ছাড়াই। এটিই এখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির সড়ক। ভাঙ্গার উপর থেকে দেখলে গোল চত্বরকে ফুটন্ত ফুলের মত মনে হয়। রাতের বেলা এই মোড়ের সড়কবাতিগুলো জ্বলে উঠলে সে সৌন্দর্য্যে যোগ হয় অন্য মাত্ৰা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম অগ্রাধিকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের নান্দনিক এই সড়ক মোড়টি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ।পদ্মা সেতুসহ ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও আবাসিক এলাকা।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে মহাসড়কটি অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সামগ্রিক জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে।বর্তমানে ও ভবিষ্যতে পদ্মা সেতু হওয়ার পর যাতে কোনো যানজট না লাগে সেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকেই এমন আধুনিক নকশায় ভাঙ্গা মোড়টি নির্মাণ করা হয়েছে।চারদিক থেকে চারটি করে আলাদা সড়ক বেরিয়ে আসায় একদিক থেকে অন্যদিকের সড়কে যাওয়া সহজ।না মেশার কারণে নিরাপত্তা বাড়ার পাশাপাশি যানজট সৃষ্টির সুযোগ থাকবে না।যাতায়াতে সুফলের পাশাপাশি সড়কটির আধুনিক নির্মাণশৈলীতে মুগ্ধ যাতায়াতকারীরাও।এখন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে মোড়টির সৌন্দর্য দেখতে।এক্সপ্রেসওয়েটি রাজধানীর পোস্তগোলা থেকে মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার। আর নদী পার হয়ে শরীয়তপুর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার। মাঝের প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার পদ্মা সেতু যুক্ত করবে দুই পাশকে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা যেতে সময় লাগে ৪০-৪৫ মিনিট, আর আগে লাগত ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। সুবিধার পাশাপাশি এই গোল চত্বরটির কিছু অসুবিধা রয়েছে।যেমন:চালুর পর থেকেই ভাঙনের মুখে পড়েছে দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ফরিদপুরের ভাঙ্গা গোল চত্বরের সড়কবাঁধ। দুই পাশে উন্নত প্রজাতির ঘাস লাগিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না ভাঙন।ভাঙনের পাশাপাশি গোল চতুর এলাকায় তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি হলেও গোল চত্বরের আশপাশে পানি জমে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। সড়ক অবকাঠামোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার জন্য সড়কবাঁধের লুপগুলোতে যে ঢাল তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেন থেকে গোল চত্বরে ওঠার ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। এতে গোল চত্বরটি রক্ষণাবেক্ষণে যেমন বাড়তি ব্যয় হচ্ছে, তেমনি সেটি ব্যবহার করতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ছেন চালকরা। তাদের অভিযোগ, গোল চত্বর ব্যবহারে জটিলতা বাড়িয়েছে ২৭০ ডিগ্রি কোণের চারটি লুপ। গোল চত্বরে গিয়ে প্রায়ই চার লুপের গোলকধাঁধায় পড়তে হচ্ছে।ভাঙ্গা গোল চত্বরের ২৭০ ডিগ্রি কোণের চারটি লুপ ভারী পরিবহন চালকদের জন্য অসুবিধা তৈরি করছে।ঢাকা থেকে ভাঙ্গা গোল চত্বর দিয়ে ফরিদপুরের দিকে যেতে হলে বৃত্তাকারভাবে ঘুরতে হয়। একই সঙ্গে বৃত্তাকার ও ক্রমশ নিচু থেকে উঁচু এবং উঁচু থেকে নিচু হওয়ার কারণে পণ্যবোঝাই ট্রাক চালাতে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। গাড়ি একটু এদিক-ওদিক হেলে গেলেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়।শুধু সড়কবাঁধে ভাঙন নয়, ভাঙ্গা গোল চত্বরের নকশার আরো কয়েকটি দুর্বলতা চিহ্নিত করেছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা।এর একটি হলো এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেন থেকে গোল চত্বরে ওঠার সুযোগ না রাখা। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে দুটি সার্ভিস লেন তৈরি করা হয়েছে ধীরগতির ও স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য। পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়ের টোল না দিয়ে যানবাহনগুলো যেন বিকল্প সড়ক হিসেবে এ সার্ভিস লেন ব্যবহার করতে পারে, সে সুযোগও রাখা হয়েছে।