প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষার একমাত্র শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো চর্যাপদ। চর্যাপদকে বলা হয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি গ্রন্থ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিবৃত্তে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে। ঐ সময়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে একখানি প্রাচীন পুথি সংগ্রহ করে আনেন। এই ঘটনার দশ বছর পরে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে 'বৌদ্ধগান ও দোহা ' নামের ঐ পুথির বিষয়বস্তু নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন। চর্যাপদের পদ গুলো মূলত গানের সংকলন। চর্যাপদের মূল বিষয়বস্তু বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব ;এতে প্রাধান্য পেয়েছে 'সাধন তত্ত্ব'। চর্যাপদের চর্যাকারদের বলা হয় মহাসিদ্ধ। 'পা' হলো পদকর্তাদের সম্মানসূচক উপাধি। এটি রচনার উদ্দেশ্য ধর্মচর্চা। রচয়িতা : বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকগণ। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সকলে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বাউল সম্প্রদায়ের। চর্যাপদের অন্যান্য নামসমূহ: চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, আশ্চর্যচর্যাচয়, চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, চর্যগীতিকোষ, চর্যাগীতিকোষবৃত্তি ইত্যাদি। অধিকাংশ পন্ডিতের মতে, চর্যাপদ রচিত হয়েছিল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ( পাল শাসনের আমলে)। ◆ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদ রচিত হয়েছিল - (৬৫০-১২০০) সালের মধ্যে ◆ ড. সুনীতিকুমার এর মতে -( ৯৬০- ১২০০) সালের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, চর্যাপদের ভাষা 'সান্ধ্যভাষা' বা আলো 'আঁধারি ভাষা'। মূলত দ্ব্যর্থক ও অস্পষ্টতায জন্যই চর্যাফদের ভাষাকে সন্ধ্যা, সান্ধ্য, বা আলো আঁধারির ভাষা বলা হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদল্লাহর মতে, চর্যাপদের ভাষা- বঙ্গকামরূপী। ম্যাক্সমুলার এর মতে, প্রচ্ছন্ন ভাষা। চর্যাপদের পাচঁটি ভাষার মিশ্রণ রয়েছে : ১. বাংলা ২. হিন্দি ৩. উরিয়া ৪. মৈথিলি ৫. অসমিয়া। চর্যার পদগুলো প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। আধুনিক ছন্দের বিচারে চর্যার পদগুলো মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। ড. মুহাম্মদ শহীউল্লাহর Buddist Mystic Songs গ্রন্থ অনুসারে - পদসংখ্যা ৫০ টি। পদকর্তা - ২৩ জন। চর্যাপদের আবিষ্কৃত পদের সংখ্যা - সাড়ে ছেচল্লিশটি। চর্যাপদের টীকাকার পন্ডিত মুনিদত্ত। চর্যাপদের সর্বাধিক পদ রচনা করেন- কাহ্নপা (১৩ টি)। চর্যাপদের শ্রষ্ঠ কবি শবরপা। চর্যাপদের ৬ টি প্রবাদ বাক্য পাওয়া গেছে। চর্যাপদের তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেন কীর্তিচন্দ্র। চর্যাপদের রচনাকালে বাঙালির জীবন ছিল কৃষিভিত্তিক। পরিশেষে বলা যায়, বাংলা গীতিকাব্যের আদি লক্ষণ যদি কোথাও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে থাকে -- তবে তা চর্যাপদে। তাই বাংলা কাব্যের ঊষালগ্নে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো কিরণ দিচ্ছে চর্যাপদ।